ঘড়িতে রাত ১২ টা ৪৭ মিনিটের মতো বাজে।অফিসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং থাকায় বেশ লেইট হয়ে গিয়েছে আজ।তবে চিন্তা নেই,কারন বাসা পুরো ফাঁকা।মা আজ সকালেই একমাসের জন্য নানার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছেন।আমার কোনো ভাইবোনও নেই।আর বাবা তো অনেক বছর আগেই মারা গিয়েছেন৷তাই বলতে গেলে জীবনের অনেকটা সময় একাই কেটেছে আমার।
যাইহোক মনের শান্তিতে নিজের টাকায় কেনা স্পোর্টস বাইকটা চালিয়ে নির্জন কোলাহল মুক্ত ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বাসার দিকে যাচ্ছিলাম।কিন্তু যেই না আমি (….) ব্রিজের কাছে যাবো,ওমনি কোথা থেকে যেনো হঠাৎ করে একটা মেয়ে আমার বাইকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে।ভাগ্য ভালো দামি বাইক হওয়ায় এবিএস সিস্টেম ছিলো বিদায় ব্রেক কষি,আর একটু হলেই মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে দিতাম।বাইক কোনো মতে থামিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ রাগি ভাবে মেয়েটার দিকে তাকালাম।বাইকের হেড লাইটের আলোতে দেখলাম তার একহাতে একটা বড় ব্যাগ,পরনে কাজ করা সাদা শাড়ি আর চোখে মুখে ভীষণ ভয়ের ছাপ।যেনো কোনো বিপদে সে পড়েছে।
আমি বাইক থামাতেই মেয়েটা আমার কাছে দৌড়ে আসে।এবার তাকে কাছ থেকে দেখছি।ভীষন রকমের সে সুন্দরী,গায়ের রঙ শ্যামলা হলেও মুখের সৌন্দর্য্য মনকাড়ার মতো।যাইহোক মেয়েটা আমার কাছে দ্রুত এসে অস্থির আর ভীতু কণ্ঠে বলছে…..
মেয়েটাঃপ্লিজ প্লিজ আমাকে একটু হেল্প করুন।আমি বিপদে পড়েছি।আমার খুব ভয় করছে।
আমি এবার ভালো করে খেয়াল করলাম মেয়েটা কাঁদছে।অসম্ভব সুন্দর মুক্তার মতো নয়নজোড়া অশ্রুতে ভরে আছে।আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম….
আমিঃশান্ত হন,কিসের বিপদ?কি হয়েছে আপনার?
মেয়েটা অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলে…..
মেয়েটাঃআমি একজনকে অনেক ভালবাসতাম।আমি তার কথা মতো আজ রাজশাহী থেকে ঢাকা এসেছিলাম তার সাথে দেখা করতে।সে বলেছি সে আজই আমাকে বিয়ে করে তার কাছে রেখে দিবে।কিন্তু সেই সকাল থেকে এখানে বসে আছি তার কোন খবর নেই।এখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।আমি বুঝে গিয়েছি সে আমাকে ধোকা দিয়েছে।আমি এখন কি করবো?(আবার কান্না শুরু)
মেয়েটা কথা শুনে ব্যথিত হলাম।এই জামানায় এমনও পাগল মানুষও আছে তা জানতাম না।. মেয়েটাকে বললাম…..
আমিঃছেলেটার নাম্বার দিন,,আমি কল করে দেখি কি বলে।
মেয়েটা আমার দিকে কান্নাসিক্ত নয়নে চুপচাপ তাকিয়ে আছে।আমিও বোকার মতো তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করছি।কিন্তু সে কিছুই বলছে না।আমি আবার বললাম….
আমিঃকই নাম্বারটা দিন।
মেয়ে এবার জোরে কান্না করে দিয়ে বলে….
মেয়াটাঃআমার ফোনটা একটু আগে টান দিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে।আমি শান্ত গলায় বললাম….
আমিঃতো কি হয়েছে!যাকে এতো ভালবাসেন তার নাম্বার মুখস্থ নেই?
মেয়েটা অসহায় মুখ করে মাথা নাড়িয়ে না বলে।আমি স্তব্ধ হয়ে যাই এবার।মনে মনে বলছি….
~ হায়রে এ কোন বিপদে পড়লাম!দ্রুত বাসায় যেত হবে।আচ্ছা এই মেয়ে আবার কোনো গ্যাংট্যাং এর সাথে জড়িত নাকি?আমাকে লুট করার জন্য মিথ্যা বলছে নাকি?আমার এবার মেয়েটাকে সন্দেহ হচ্ছে।আমি তাকে উদ্দেশ্য করে বললাম……
আমিঃতো এখন আমি কি করতে পারি আপনার জন্য?
মেয়েটা আমতা আমতা করে বলে…..
মেয়েটাঃআমাকে একটু থাকার জায়গা করে দিবেন?আমার খুব ভয় করছে।আমি ঢাকার কোনো জায়গাই চিনিনা।এখানেই আসছি অনেক কষ্ট করে।
আমিঃআমি এতো রাতে আপনাকে কোথায় থাকার ব্যবস্থা করবো?এটা ঢাকার শহর,বললেই এতো সহজে সবকিছু হয়না।
মেয়েটার মুখটা কালো হয়ে যায়।যেনো আশা হারিয়ে ফেলেছে সে।সে আশেপাশে তাকিয়ে মাথা নিচু করে আস্তে করে বলে…..
মেয়েটাঃযদি একটু দয়া করে আপনার বাসায় জায়গা দিতেন আমাকে।এতোরাতে এখানে থাকলে আমার বড় কোনো বিপদ হয়ে যাবে।
আমি এবার বুঝে ফেলি এই মেয়ের ভিতর ঝামেলা আছে।নিশ্চয়ই কোনো ধান্দা করার ফন্দি পেতেছে।আমি বাইক স্টার্ট দিয়ে বলি…..
আমিঃএইসব ধান্দাবাজি আমার সাথে চলবে না।আপনাকে চিনি না জানিনা আমি আপনাকে সোজা বাসায় নিয়ে যাবো,তারপর আমাকে মেরে আমার টাকা পয়সা সব নিয়ে পালিয়ে যাবেন।বাহ!ভালোই বুদ্ধি বানিয়েছেন।কিন্তু সরি,কাজ হলো না।আপনাকে আমি কোনো প্রকার সাহায্য করতে পারছিনা।আমি গেলাম,,,,,
দেখলাম মেয়েটা আশ্চর্য্য হয়ে মলিন মুখে আমার থেকে সরে দাঁড়ায়।যেনো সে এসব কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।আমি তার দিকে আর খেয়াল না দিয়ে বাইক টান দিলাম।লুকিং গ্লাসে দেখি মেয়েটা আইলাইনারের উপর বসে ব্যাগটা জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে শুরু করলো।
এই দৃশ্য দেখে মনে একটা কামড় দিলো।ভাবলাম যে আমি কি ভুল বুঝলাম মেয়েটাকে?আমি বাইকটা একটু সামনে নিয়ে আবার স্টার্ট অফ করে চুপচাপ আড়ালে দাঁড়িয়ে লুকিং গ্লাসে মেয়েটা কি করে তা দেখার চেষ্টা করলাম। দেখলাম সে বসে বসে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।
যদি সে খারাপ কেউ হতো তাহলে সে অন্য কাউকে ধরার চেষ্টা করতো।কারন একটু পরপর প্রাইভেট কার আর বাইক যাচ্ছিলো অনেক।সে চাইলে তাদেরকেও আটকাতে পারতো।কিন্তু মেয়েটা বসে বসে কেঁদেই যাচ্ছে।তাহলে আমি মেয়েটাকে ভুলই বুঝেছি।মনটা খারাপ হলো। বাইকটা আবার স্টার্ট দিয়ে মেয়েটার কাছে গেলাম।সে আমাকে দেখে পুরো অবাক।কিন্তু পরক্ষনেই মাথা নিচু করে আগের মতো কাঁদতে থাকলো নিঃশব্দে।আমি বাইক থেকে নেমে তার সামনে গিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে বসলাম।সে আমার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।বোধহয় রাগ করেছে আমার আগের কথা শুনে।আমি এবার মেয়েটাকে বললাম…..
আমিঃআমার বাসার বর্তমানে আমি ছাড়া কেউই নেই৷আপনি কি তাও আমার বাসায় যাবেন?ভয় করবে না আপনার?যদি আমি কোন ক্ষতি করি আপনার,,,!
মেয়েটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে বললো….
মেয়েটাঃআপনি খারাপ হলে কখনোই আবার আসতেন না আর আমাকে এটাও বলতেন না যে আপনার বাসায় কেউ নেই।আমি এতোটুকু বুঝি।
আমি কিঞ্চিৎ হাসলাম।আর বললাম…..
আমিঃআপনার মতো মেয়ে মানুষও যে দুনিয়ায় আছে জানা ছিলো না।কেমন মানুষকে ভালবাসলেন যে আপনাকে এরকম একটা বিপদে ফেলে দিলো।যাইহোক আজ রাতটা আমি আপনাকে আমার বাসায় থাকতে দিতে পারি। কিন্তু কালকে সকালে অবশ্যই রাজশাহী ফিরে যাবেন আপনার বাবা-মার কাছে।
মেয়েটা চুপচাপ মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বললো।আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম…..
আমিঃতাহলে চলুন আপনাকে নিয়ে যাই আমার বাসায়।
মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়ে বাইকের কাছে আসলো কিন্তু বাইকে না উঠে কিছুক্ষন ভেবে বললো…..
মেয়েটাঃআচ্ছা বুঝলাম আপনি ভালো কিন্তু আবার পরে খারাপ হয়ে যাবেন না তো?সত্যি করে বলুন?প্লিজ আমি খুব বিপদে আছি,বুঝতেই পারছেন।
আমি মেয়েটার কথা শুনে হাসবো নাকি কাঁদবো জানি না৷তাও নিজেকে সামলে বললাম…..
আমিঃবিশ্বাস না হলে আমার সাথে আইসেন না।আমারই ভালো হবে।আমি চলে যাই…..
মেয়েটাঃনা না আমি যাবো যাবো।
বলেই মেয়েটা আমার বাইকে চড়ে বসে।আমি তাকে আমার হেলমেটটা দিলাম।সে হাতে নিয়ে বললো…..
মেয়েটাঃআপনি কি পরবেন তাহলে!
আমিঃসমস্যা নেই।আপনার সেইফটি আগে। আপনার দায়িত্ব নিয়েছি,অবহেলা কিভাবে করি বলুন,,!
মেয়েটাঃযদি পুলিশ আপনাকে ধরে?
আমিঃধরবে না,আমি ভিতর দিয়ে যাবো।
মেয়েটাঃওহ,তাহলে চলুন।
আমিঃআপনি ঠিক ভাবে বসেছেন তো?
মেয়েটাঃবসেছি কিন্তু ভয় করছে।
আমিঃকেন?
না মানে আসলে আমি আগে কখনো বাইকে উঠিনি….
আমিঃহাহা…ভয় নেই…আমি আস্তে আস্তে চালাবো।উমম আপনি আমার শার্টটা ধরে বসুন।তাহলে ভয় কম লাগবে?
মেয়েটাঃচান্স নিতে চাচ্ছেন নাকি?
আমিঃহায়রে মেয়ে মানুষ!আপনি তো অন্যের প্রেমিকা।আপনার সাথে আবার কিসের চান্স নিবো!বেশি সমস্যা হলে নেমে পড়ুন আমার দেরি হচ্ছে।
মেয়েটাঃনা না সরি সরি।চলুন….
মেয়েটা আমার শার্টটা ধরে বসলো।সে আগেই ধরতে চেয়েছিলো কিন্তু সেটা মনে মনে।হয়তো লজ্জার কারনে ধরতে পারেনি তাই আমিই বললাম।
কিন্তু শয়তান মেয়েটা কি বলে আমাকে,আমি নাকি চান্স নিতে চাচ্ছি!মানে ভালোদের কোনো দামই নেই দুনিয়ায়।যাইহোক এবার বাইক চালু করে বাসার দিকে রওনা হলাম।সেই একই নিঝুম রাতে নিরিবিলি ঠান্ডা রাস্তায় বাইক চালিয়ে প্রতিদিনের মতো বাসায় যাচ্ছি।কিন্তু আজ একটু ব্যতিক্রম।আজ আমি একা না,আজ সাথে একজন নতুন মানুষ আছে।যার কোনো কিছুই আমি জানিনা।ইভেন নামটাও না।আল্লাহ জানে সাহায্য করতে গিয়ে আবার কোন বিপদ সাথে করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি।কোনো রকম না ঘুমিয়ে আজ রাতটা পাড় করে আগামকাল সকালেই ওনাকে রাজশাহী পাঠিয়ে দিবো।মনে মনে এসব ভেবে বাসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।তাও আবার অন্যের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে।কি কপাল আমার!দেখা যাক বাসায় গিয়ে কি হয়…..
চলবে…..