অপরিচিতা মেয়ে যখন আদুরে বউ পর্ব_০৪

ভোরের ঝলমল আলোতে আমার ঘুম ভাঙে।ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি সকাল ৮ টা ২০ মিনিট বাজে।আজ শুক্রবার।সচারাচর এই দিনে আমি বারোটার আগে ঘুম থেকে উঠিই না কিন্তু আজ জানালার পাশে সোফায় ঘুমানোর কারনে ঘুমটা সকাল সকাল ভেঙে যায়।অপূর্ণ ঘুম নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসতেই সবার আগে জান্নাতের অসম্ভব সুন্দর ঘুমন্ত মুখখানা আমার চোখে পড়ে।লেখক আবিরের গল্পেই পড়েছিলাম যে,একটা মেয়ের সত্যিকারের সৌন্দর্য্য দেখতে হলে তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে হবে।আমি আজ তা দেখছি।আহ!কি মায়াবী মলিন নেশাকাতর মুখ তার।আমি বুঝিনা কিভাবে এই মেয়ের প্রেমিক তাকে গ্রহণ করলো না।আমার মাথায়ই ঢুকে না ব্যাপারটা।কি জানি!সত্যিকারের প্রেম ভালবাসা আজকালকার দিনে কোনো মূল্য নেই।তাই তো আজও একাই আছি।

মা কতোবার বিয়ে করতে বললো কিন্তু আমার কোনো মেয়েকেই পছন্দ কিংবা ভালো লাগেনা।সত্যিই বলতে তাদের বিশ্বাসই করতে পারিনা।আজকালকার মেয়েরা শুধু মন নিয়ে খেলতে জানে।তারা একটা ছেলের অনুভূতি অনুভব কিংবা মনের গহীন জমে থাকা ভালবাসা আর কষ্টগুলোকে কখনোই বুঝতে চায় না।সবকিছু তাদের কাছে নেহায়েত রঙ তামাশা।হ্যাঁ আমারও একজন ছিলো অনেক আগে।তখন আমি কলেজে পড়তাম।কিন্তু সে যে এভাবে আমার মন ভেঙে চলে যাবে আমি তা আর ভাবিনি।যাইহোক অতীত মানেই কষ্টকে স্মরণ করা।যেটা আমি চাইনা।এতো সুন্দর সকালটা নষ্ট হোক তাও চাই না।আমি উঠে ফ্রেশ হলাম কারন জান্নাতকে আজ যেভাবেই হোক রাজশাহী পাঠাতে হবে।আমি ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আমার বেড খালি।কি হলো!জান্নাত কোথায় গেলো?আমি রুম থেকে বের হয়ে গেস্ট রুমে নজর দিলাম।দেখি রুম রাতের মতোই আছে।ওয়াশরুমও বাইরে থেকে লাগানো।আর মায়ের রুমতো আমি তালাই মেরে রেখেছি।তাহলে মেয়েটা সকাল সকাল গেলো কই!মেইন গেইটের কাছে এসে দেখি সেটাও ভিতর থেকে লাগানো।তাহলে…..

আমি একটু ভাবতেই আমার মনে পড়ে যে আমি তো আমার রুমের বারান্দাই দেখিনি।আমি দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দেখি।হ্যাঁ মিস জান্নাত আমার বারান্দায় মনের সুখে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছে।আমার বাসার সামনে অনেক বড় ফাঁকা জায়গা তাই দক্ষিনের মনোরম হাওয়া আসতে কোনো বাঁধাই পায় না।আমিও মাঝে মাঝে সকালে আর রাতে বারান্দায় বসে কিছু সময় কাটাই।বেশ শীতল ঠান্ডা বাতাস আসে এই সাত তলায়।ভালোই লাগে।জান্নাতও বোধহয় তেমনই লাগছে।

আমি হালকা কাশি দিলে জান্নাত আমার দিকে তাকিয়ে ওড়নাটা ঠিক করে নেয়।আমি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম।রাতের চেয়ে জান্নাতকে এখন বেশ স্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে।ওর গায়ের রঙ দুধের মতো একটা সাদা না হলেও ওর গায়ের রংটা বেশ মনকাড়া।আমাকে দেখে জান্নাত লজ্জা পেলো আর আস্তে করে শুভ সকাল বললো।আমিও হেসে তাকে সকালের শুভেচ্ছা জানালাম।আর বললাম…..

আমিঃআপনি ফ্রেশ হয়ে নিন।আমি নাস্তা নিয়ে আসি।খেয়েই আমরা রেল স্টেশনে রওনা হবো।আপনাকে রাজশাহীর ট্রেনে উঠিয়ে দিবো৷তারপর আপনি আপনার বাসায় আর আমি আমার।

দেখলাম জান্নাত চুপচাপ শুধু আমার কথা শুনলো কিন্তু কোনো রকম প্রতিক্রিয়া জানালো না।আমি সেদিকে খেয়াল না দিয়ে মায়াকে বাসায় রেখে বাইরে থেকে লক করে নাস্তা আনতে চলে গেলাম।নাস্তা এনে বাসায় ঢুকে দেখি জান্নাত চুপচাপ মুখ কালো করে হল রুমে বসে আছে।আমি ডাইনিং রুমে নাস্তা রেখে তার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলাম…..

আমিঃকি হলো আপনি এই সকাল সকাল মুখ কালো করে বসে আছেন কেন?কি হয়েছে?আপনার তো খুশি হবার কথা আপনি আবার আপনার পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন।তাহলে এভাবে মন খারাপ করে আছেন কেন?

জান্নাত হঠাৎই কান্না করতে করতে বললো…..

জান্নাতঃআমি এখান থেকে কোথাও যাবো না।

আমি এই কথা শুনে ঠাস করে সোফার উপর বসে পড়ি।হায় হায়!এই পাগলি মেয়ে বললো কি!আবার কোন বিপদে পড়লাম!আমি কোনোরকম নিজেকে সামলে জান্নাতকে জিজ্ঞেস করলাম…..

আমিঃমানে!কি বলছেন?কেন যাবেন না আপনি?কি হয়েছে?

জান্নাত কান্না করতে করতে বললো…..

জান্নাতঃআমি এখন বাসায় গেলে আমার বাবা আমাকে মেরে ফেলবে।আর সত্যি বলতে আমি ওকে খুঁজে বের করতে চাই।ওকে জিজ্ঞেস করবো ও কেন এমন করলো আমার সাথে।আপনি প্লিজ আমাকে আর ক’টা দিন থাকতে দিন।প্লিজ…..

জান্নাত হাত জোর করে বললো।আমি ওকে জোর দিয়ে বললাম…..

আমিঃদেখুন জান্নাত আমি এটা করতে পারবো না।আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।একটা মেয়ের সাথে এভাবে একটা ছেলে থাকতে পারে না।আর আমার মাও আসবে একমাস পর।সো কোনোভাবেই সম্ভব না।আপনি তার চেয়ে রাজশাহী চলে যান।আপনি যাকে ভালবাসতেন সে কখনোই আপনার ছিলোনা।সো তাকে খুঁজার কোন মানেই হয়না।যে একবার চলে যায় সে আর কখনোই ফিরে আসে না।আপনি রেডি হন,আমি আপনাকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে আসি।

জান্নাত উঠে দাঁড়িয়ে বলে…..

জান্নাতঃঠিক আছে,পাঠিয়ে দিন আমাকে।কিন্তু আমি মাঝ পথে ট্রেন থেকে লাফিয়ে জীবন দিয়ে দিবো।কারন এখন বাসায় গেলে আমাকে এমনিও মরতে হবে।তারচেয়ে নিজেই মরে যাবো।চলুন…..

আমি স্তব্ধ হয়ে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে আছি।সে কি বললো এটা!জীবন দিয়ে দিবে!জীবন কি এতোই সস্তা নাকি?আমি জান্নাতের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বললাম…..

আমিঃঠিক আছে ঠিক আছে,আপনি শান্ত হন।কোথাও যেতে হবে না আপনাকে।আমার পোড়া কপাল।নিজের কপালে যাকে কুড়াল মারা বলে।এখন তো আর কিছুই করতে পারবো না।আপনি যা বলবেন তাই হবে।তাও নিজের কোনো ক্ষতি করবেন না প্লিজ।

জান্নাত মুহূর্তেই খুশিতে আত্নহারা হয়ে যায়।সে আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে…..

জান্নাতঃসত্যিই বলছেন তো?আমাকে আবার পাঠাতে চাইবেন না তো?

আমি রাগান্বিত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে না বললাম।সে খুব খুশি হলো।চোখ মুখ মুছে সোফায় বসে বললো…..

জান্নাতঃআপনার বাসাটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে আর আপনাকেও হিহি।আপনি খুব ভালো মানুষ।অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে।

আমিও সোফায় হেরে যাওয়া সৈনিকের মতো বসে পড়ি আর জান্নাতের আনন্দমাখা মুখখানা দেখতে থাকি।হায়রে মেয়ে মানুষ,তারা চাইলে কিনা পারে।কিভাবে আমাকে জিম্মি করে ফেললো মুহূর্তেই।আমি তার ব্যাগটা পাশে রেখে জিজ্ঞেস করলাম…..

আমিঃকতোদিন এখানে থাকতে চান আপনি?আমার মা এসব জানতে পারলে আমাকে মেরে ফেলবে।যদি নাও মারে সে আর কোনোদিন আমার সাথে কথা বলবে না।এই দুনিয়াতে আমার মা ছাড়া আমার আপন আর কেউ নেই।সো বলেন কবে যাবেন আপনি?

জান্নাতঃআপনার মা আসার আগেই চলে যাবো আমি।ভয় নেই।শুধু কয়টাদিন একটু থাকতে দিন প্লিজ।এখন বাসায় গেলে আমার খুব ক্ষতি হবে৷

খেয়াল করলাম জান্নাত কথাগুলো বলার সময় খুব ভিতু আর চিন্তিত হয়ে বলছিলো।বুঝলাম এখন গেলে তার সত্যিই সমস্যা হবে।আমি পুরো ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি সকাল সকাল এত কাহানী দেখে।সোফায় গাটা এলিয়ে দিয়ে ফেড আপের মতো বসে রইলাম।জান্নাত আমাকে দেখে আস্তে করে অসহায় কণ্ঠে বলছে…..

জান্নাতঃপ্লিজ আপনি আমার উপর রাগ করে থাকবেন না৷আপনার দুনিয়ায় তো আপনার আপন মা আছে যে আপনাকে অনেক ভালবাসে।আমার দুনিয়ায় আমার আপন কেউ নেই,কেউ না৷তাই আপনার এখানে একটু আশ্রয় নিতে চাই।তারপর সত্যিই বলছি আমি চলে যাবো প্রমিস৷

আমি জান্নাতের বাচ্চামো কথা শুনে মুচকি হাসলাম।জান্নাতও বোধহয় তা দেখেছে।ও আবার বলে…..

জান্নাতঃআপনার বোধহয় ক্ষুধা লেগেছে অনেক।আমি নাস্তা বেরে দিচ্ছি।আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।

আমি বুঝলাম ক্ষুধা আমার না এই মহিষীনিরই লেগেছে।আমি আবার মুচকি হেসে নিজের রুমে গেলাম৷মাকে একটা ফোন দিতে হবে নাহলে সে চিন্তা করবে।আমি ফোন নিয়ে সোজা বারান্দায় গিয়ে মাকে কল দিলাম।কিছুক্ষন রিং হতেই মা ফোন ধরলো আর বললো…..

মাঃকিরে রাশেদ আজ তুই এতো সকালে ঘুম থেকে উঠলি?কোন সমস্যা হয়েছে বাবা?

এইরে!আসলেই তো,আমি তো কখনো এতো সকালে শুক্রবার ঘুম থেকে উঠি না।এখন মাকে কি বলবো!মাকে আমি কখনোই মিথ্যা বলতে পারি না তাই বললাম…..

আমিঃনা না মা কোন সমস্যা হয়নি।ভোরের কড়া আলোতে আজ ঘুমটা তাড়াতাড়ি ভেঙে গিয়েছে।তাই ভাবলাম উঠেই পড়ি।আমার কথা রাখো,তুমি কেমন আছো সেটা বলো?

মাঃআমি আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।তোর কণ্ঠটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে বাবা।কিছু হয়েছে?

আমিঃনা না মা।ওই সকাল সকাল উঠেছি তো তাই।তুমি চিন্তা কইরো না।তুমি আরাম করে বেড়িয়ে আসো।আমি তো সারাদিন বাইরে থাকি।তুমি একা একা বসে থাকো সারাদিন।এখন ওখানে সবার সাথে আছো আনন্দ করো।আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না।

মাঃতুই একটা বিয়ে করলে আমার আর এতোদূর আসতে হতো না।আমি বউমাকে নিয়েই ভালো থাকতাম।

আমিঃএই যে শুরু হইছে।বিয়া সাদি আমার ভালো লাগে না।আর করলেও আরও পরে।মেয়ে মানুষরা অনেক জ্বালায় মা।(জান্নাতের কথা ভেবে বললাম)

মাঃকি!আমি তোকে জ্বালাই?ঠিক আছে যা আমি আর বাসায় আসবোই না।

আমিঃআরে না না,তোমাকে বলিনি।তুমি তো মা।তোমার মতো ভালো মা আর কেউ হয় না।

মাঃহইছে মাকে আর পাম দিস না।ঠিক মতো থাকিস।রান্না বান্না নিজে না করে পারলে বাইরে থেকে এনে খেয়ে নিস।

আমিঃঠিক আছে মা আর শোনো…..

আমি যেই মাকে বাকি কথাটুকু বলতে যাবো ওমনি জান্নাত আমাকে ডাকতে ডাকতে বারান্দায় আসে৷

জান্নাতঃরাশেদ মশাই,এইযে রাশেদ মশাই কই আপনি?

আমি তো পুরো নাই।জানের পানি একদম শুকিয়ে গিয়েছে।চোখ দুইটা বড় বড় করে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে ওকে এক টান মেরে কাছে এনে ওর মুখ চেপে ধরি হাত দিয়ে।ও দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।আমি দ্রুত মাকে বললাম…..

চলবে…..

More From Author

You May Also Like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *